সুরা বাকারা ঃ- ০২ঃ১৫২
কুরআন ও হাদীসের আলেকে যিকির
কুরআন হাদীসের আলোকে আমরা দেখি যে, আল্লাহর যিকির বা মহান রাব্বুল আলামীনের স্মরণই মূলত ইসলাম। মুমিনের সকল কর্মই তো তার প্রতিপালক রাব্বুল আলামীনকে কেন্দ্র করে ও তাকেই স্মরণ করে। কাজেই, তার সকল কর্মই যিকির। কুরআন ও হাদীসে এভাবে আমরা যিকিরকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত দেখতে পাই। ঈমান, কুরআন, সালাত, সিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদতকেই যিকির বলা হয়েছে। আবার এগুলোর অতিরিক্ত তাকবীর, তাহলীল, তাসবীহ, দুআ ইত্যাদিকেও যিকির নামে অভিহিত করা হয়েছে।
কুরআন ও হাদীসের এসকল ব্যবহারের আলোকে আমরা যিকিরকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। - ইসলামে যে সকল ফরজ বা নফল ইবাদতের অন্য ব্যবহারিক নাম রয়েছে, তবে যেহেতু সকল ইবাদতের মূলই আল্লাহর স্মরণ, এজন্য সেগুলোকেও যিকির নামে অভিহিত করা হয়েছে।
- যে সকল ফরজ বা নফল ইবাদত শুধুমাত্র যিকির নামেই অভিহিত এবং অন্যান্য সকল ইবাদতের অতিরিক্ত শুধুমাত্র আল্লাহর স্মরণের জন্য পালন। নিচে যিকির শব্দের বিভিন্ন ব্যবহার আলোচনা করা হল ঃ-
আল্লাহর আনুগত্যমূলক কর্ম ও বর্জন
মহান আল্লাহ বলেন, (আরবী)
“তোমারা আমার যিকির কর, আমি তোমাদের যিকির করব।” (সোর্সঃ- সুরা বাকাবাঃ ০২ঃ১৫২)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী-তাবেয়ীগণ বলেন; এখানে যিকির বলতে সকল প্রকার ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্য করাই বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর যিকির করা। আর বান্দাকে প্রতিদানে পুরুস্কার, করুণা, শান্তি ও বরকত প্রদানই আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাকে যিকির করা। (সোর্সঃ- তাফসীরে তাবারীঃ- ২/৩৭)
ইমাম তাবারী এ প্রসঙ্গে বলেন; “হে মুমিনগণ, আমি তোমাদেরকে যে সকল আদেশ প্রদার করেছি তা পালন কর এবং যা নিষেধ করছি তা বর্জন করে তোমরা আমার আনুগত্যের মাধ্যমে আমার যিকির কর। তাহলে আমি তোমাদেরকে আমার রহমত, দয়া ও ক্ষমা প্রদানের মাধ্যমে তোমাদের যিকির করব।” (সোর্সঃ- তাফসীরে তাবারীঃ- ২/৩৭) আব্দুল্লাহ ইবনু রাবীয়াহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন; “আল্লাহর যিকির তার তাসবীহ, তাহলীল, প্রশংসা জ্ঞাপন, কুরআন তিলাওয়াত, তিনি যা নিষেধ করেছেন তার কথা স্মরণ করে তা থেকে বিরত থাকা-- এ সবই আল্লাহর যিকির। (সোর্সঃ- তাফসীরে তাবারীঃ- ২০/১৫৬)
প্রখ্যাত মহিলা সাহাবী উম্মে দারদা (রাঃ) বলেন;
(আরবী) “তুমি যদি সালাত আদায় কর তাও আল্লাহর যিকির, যদি সিয়াম পালন কর তাও আল্লাহর যিকির। তুমি যা কিছু ভাল কাজ কর সবই আল্লাহর যিকির। যত মন্দ কাজ তুমি পরিত্যাগ করবে সবই আল্লাহর যিকিরের অন্তর্ভুক্ত। তবে সেগুলির মধ্যে উত্তম আল্লাহর তাসবীহ (‘সুবহানাল্লাহ’) বলা।” (সোর্সঃ- তাফসীরে তাবারীঃ- ২০/১৫৭)
মহান আল্লাহ বলেন;(আরবী) (আল্লাহর ঘরে আল্লাহর যিকিরকারী মানুষগণকে) কোনো ব্যবসা বা কেনা বেচা আল্লাহর যিকির থেকে অমনোযোগি করতে পারে না। (সোর্সঃ- সূরা নূরঃ- ৩৭ )
তাবেয়ীগণ কিভাবে যিকির করত এ আয়াতে আল্লাহর যিকিরের ব্যাখ্যায় তাবেয়ী কাদাতা বলেন; এ সকল যাকির বান্দা ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকতেন। যখনই আল্লাহর কোনো পাওনা বা তার প্রদত্ত কোনো দায়িত্ব এসে যেত তারা তৎক্ষণাৎ তা আদায় করতেন। ব্যবসা বা বেচা কেনা তাদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে বিরত রাখত না। (সোর্সঃ- বুখারীঃ ৩৯/কিতাবুল বুয়ূ, ৮বাব তিজারাহ ফিল বিররঃ ২/৭২৬, ২/৭২৮, ভারতীয়ঃ ১/২৭৭)
তাবেয়ীগণ মুখের যিকিরের গুরুত্ব দিতেন। তবে এগুলো নফল যিকির। কর্মে আল্লাহর বিধিবিধান না মেনে এ সকল যিকির পালন করাকে তারা মূল্যহীন বলে গণ্য করতেন। তাবেয়ী সাঈদ বিন জুবাঈর (৯৫ হিঃ) বলেন; (আরবী) “আল্লাহর আনুগত্যই আল্লাহর যিকির। যে তার বিধিবিধান পালন করল না, সে যত বেশিই তাসবীহ পাঠ করুক আর কুরআন তিলওয়াত করুক সে যাকির হিসাবে গণ্য হবে না।” (সোর্সঃ যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালাঃ ৪/৩২৬) এ অর্থেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। তাবেয়ী খালিদি ইবনু আবী ইমরান (১২৫ হিঃ) বলেন; রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: (আরবী); “যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করল সে আল্লাহর যিকির করল, যদিও তার সালাত, সিয়াম ও কুরআন তিলাওয়াত কম হয়। আর যে আল্লাহর অবাধ্যতা করল সে আল্লাহকে ভুলে গেল, যদিও তার সালাত, সিয়াম ও কুরআন তিলাওয়াত বেশি হয়।” [[[তাবেয়ী খালিদ পযর্ন্ত সনদ সহীহ। তবে হাদীসটি মুরসাল। ঠিক এ শব্দে ও অন্য সনদে সাহাবী ওয়াকিদ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। এ সনদটিতে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই, কিন্তু সনদটি দুর্বল। দুটি পৃথক সনদে বর্ণিত হওয়াতে হাদীসটির নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত এ কারণে ইমাম সুয়ুতী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আলবানী হাদীসটিকে যয়ীফ বলেছেন। (সোর্সঃ তারাবানী, আল-মুজামুল কাবীরঃ ২২/১৫৪; বাইহাকী, শুআবুল ইমানঃ ১/৪৫২; ইবনুল মুবারাক, কিতাবুয যুহদঃ ১/১৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদঃ ২/২৫২; আব্দুর রাউফ মুনাবঅ, ফাইযুল কাদীরঃ ৬/৭০; আলবানী, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীরঃ ৭৮৫ পৃঃ]]] আল্লামা আব্দুর রাউফ মানাবী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন; ‘এ থেকে বুঝা যায় যে, যিকিরের হাকীকত আল্লাহর আনুগত্য করা, তা আদেশ পালন করা ও নিষেধ বর্জন করা।’ এজন্য কোনো কোনো ওলী বলেছেন; ‘যিকিরের মূল আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া। যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপের মধ্যে লিপ্ত থেকেও মুখে আল্লাহর যিকির করে সে মূলত আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সাথে উপহাসে লিপ্ত এবং আল্লাহর আয়াত ও বিধানকে তামাশার বস্ত হিসাবে গ্রহন করেছে।’ (সোর্সঃ মুনাবী, ফাইযুল কাদীরঃ ৬/৭০) তাবেয়ী হাসান বসরী বলেন: আল্লাহর যিকির দুই প্রকার; প্রথম প্রকার যিকিরÑ তোমার নিজের ও তোমার প্রভুর মাঝে মুখে জপের মাধ্যমে তার যিকির করবে। এ যিকির খুবই ভাল এবং এর সওয়াবও সীমাহীন। দ্বিতীয় প্রকার যিকির আরো উত্তম; আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তার কাছে তার যিকির করা। অর্থাৎ, আল্লাহর কথা স্মরণ করে তার নিষেধ কর্ম থেকে বিরত থাকা। (সোর্সঃ গাযালী, এহইয়াউ উলূমুদ্দীনঃ ১/৩৫১) তাবেয়ী বিলাল ইবনু সা’দ বলেন; ‘যিকির দু প্রকারঃ- প্রথম প্রকার জিহ্বার যিকির, এ যিকির ভালো। দিত্বীয় প্রকার হালাল-হারাম ও বিধিনিষেধ যিকির। সকল কর্মের সময় আল্লাহর আদেশ নিষেধ মনে রাখা। এ যিকির সর্বোত্তম।’ (সোর্সঃ বাইহাকী, শু’আবুল ঈমানঃ- ১/৪৫২) তাবেয়ী মাসরুক বলেন; ‘যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির ক্বলব আল্লাহর স্মরণে রত আছে, ততক্ষণ সে মূলত সালাতের মধ্যে রয়েছে, যদিও সে বাজারের মধ্যে থাকে। (সোর্সঃ বাইহাকী, শু’আবুল ঈমানঃ ১/৪৫৩) অন্য তায়েবী আবু উবাইদাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ বলেন; ‘যতক্ষন পর্যন্ত ব্যক্তির অন্তর আল্লাহর স্মরণে রত থাকে, ততক্ষণ সে মূলত সালাতের মধ্যেই রয়েছে। যদি এর সাথ তার জিহ্বা ও দুই ঠোঁট নড়াচড়া করে (অর্থাৎ, মনের স্মরণের সাথে সাথে যদি মুখেও উচ্চারণ করে) তাহলে তা হবে খুবই ভালো, বেশি কল্যানময়।’ (সোর্সঃ বাইহাকী, শু’আবুল ঈমানঃ ১/৪৫৩)
পর্বঃ- ০১
সোর্সঃ- রাহে বেলায়াত
|